মহররম মাসের দশ তারিখে সংঘটিত ঘটনাবলী মুসলিম উম্মাহর জন্য সঠিক পথ প্রাপ্তি, কৃতজ্ঞতাজ্ঞাপন, দুনিয়ার শান্তি ও পরকালের মুক্তির জন্য অনন্য শিক্ষা ও অনুপ্রেরণা। পৃথিবীর আদি-অন্তের ঘটনা এর সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছে। এই দিনে হজরত মুসা আলাইহিস সালাম যেমন ফেরাউনের কবল থেকে মুক্ত হয়েছিলেন; তেমনি দুনিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে দুঃখময় ঘটনা কারবালা প্রান্তরে হজরত ইমাম হুসাইন ও তাঁর পরিবারবর্গের শাহাদাত এক বেদনাদায়ক অধ্যায় রচিত হয়েছিল।
তৎকালীন শাসক ইয়াজিদের সৈন্য কর্তৃক ফোরাত নদীর তীরে কারবালার কঙ্করময় মরু প্রান্তরে নির্মমভাবে শহীদ হয়েছিলেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কলিজার টুকরা নাতি, হজরত ফাতেমা রাদিয়াল্লাহু আনহার নয়নমণি হজরত ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুসহ তাঁর ৭৭ জন পরিজন ও ঘনিষ্ঠজন।
এভাবে আশুরার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও মূল্যবোধের সঙ্গে শুধু কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনাই জড়িত নয়; বরং এই দিনে ইসলামের ইতিহাসে পৃথিবীর বহু ঐতিহাসিক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। আল্লাহ তাআলা এই দিনে তাঁর কুদরতের বহু নিদর্শন প্রকাশ করেছেন। হাদিসে পাকে এসেছে-
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা এই দিনে বনি ইসরাঈলের জন্য সমুদ্রে রাস্তা বের করে দিয়েছেন এবং তাদেরকে নিরাপদে পার করে দিয়েছেন। আর একই রাস্তা দিয়ে ফেরাউন ও তার অনুসারীদেরকে ডুবিয়ে মেরেছেন।’ (বুখারি)
দ্বিতীয় হিজরির রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার আগে আশুরায় রোজা রাখা ফরজ ছিল। রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার পর আশুরার রোজা নফল হয়ে যায়। তবে বছরের অন্য যেকোন দিনে নফল রোজার চেয়ে আশুরার দিনে নফল রোজা রাখার গুরুত্ব ও ফযিলত অনেক বেশি। মহররাম মাস ও আশুরার রোজা সম্পর্কে হাদিসে এসেছে-
১. হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজান ও আশুরায় যেরূপ গুরুত্বের সঙ্গে রোজা রাখতে দেখেছি অন্য সময় তা দেখিনি।’ (বুখারি)
২. হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘রমজানের পর সর্বোত্তম রোজা হচ্ছে মহররাম মাসের রোজা। সুতরাং এ মাসে রোজা রাখা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সুমহান আদর্শ।
৩. আশুরার রোজা সম্পর্কে হাদিস শরিফে আরও বর্ণিত হয়েছে, রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনায় এসে দেখলেন ইয়াহুদিরা আশুরার দিন রোজা রাখছে। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আমরা তো তাদের অপেক্ষা হযরত মুসা আলাইহিস সালামের অনুসরণের অধিক যোগ্য। এরপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেও এদিনে রোজা রাখলেন এবং উম্মতকেও রোজা রাখাতে বললেন। (বুখারি)
৪. ইয়াহুদি-খ্রিস্টানরা আশুরার দিনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে রোজা রাখে। তাই রাসুলুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইয়াহুদিদের সাদৃশ্য পরিত্যাগ করে মহররামের ১০ তারিখের রোজার সঙ্গে তার আগের দিন অথবা পরের দিন (৯ অথবা ১১ মহররাম) মিলিয়ে দুইটি রোজা রাখতে বলেছেন।
৫. রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আশুরার রোজার মাধ্যমে বিগত এক বছরের সগিরাহ গোনাহসমুহ মাফ হয়ে যায়।’
৬. অন্য বর্ণনায় রয়েছে, ‘যে ব্যক্তি উদার চিত্তে মুক্ত হস্তে আশুরার দিন দান-খয়রাত করবে, আল্লাহ তাআলা সারা বছর তার রুজি-রোজগারে বরকত দান করেন।’
সুতরাং মুমিন মুসলমানের উচিত, মহররাম মাসের দিকনির্দেশনা মোতাবেক মহররমসহ সবসময় জুলুম-অত্যাচার থেকে বিরত থাকা। আশুরার দিনের করণীয় মেনে রোজা পালন, দাস-সাদকা ও ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে হাদিসে ঘোষিত ফজিলত অর্জন করার চেষ্টা করা।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহজকে মহররম ও আশুরায় বেশি বেশি দান-খয়রাত, তাওবা-ইস্তেগফার, নফল রোজা ও অন্যান্য নেক আমল করার তাওফিক দান করুন। কুরআন-সুন্নাহর দিকনির্দেশনা মেনে চলার তাওফিক দান করুন। আমিন।