ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বিদ্রোহীদের কাছে ধরাশায়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীরা। অনেক ইউপিতে দলীয় প্রার্থীরা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়ই আসতে পারছেন না। এমনই চিত্র উঠে এসেছে সোমবার অনুষ্ঠিত ১১৭টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের ফলাফলে।
এ নির্বাচনে ৭৬টিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। অপরদিকে দলটির বিদ্রোহী প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছেন ২৪ জন। খুলনার দিঘলিয়া উপজেলার চার ইউপির একটিতেও দলটির প্রার্থীরা জয় পাননি।
এদিকে অনেক ইউপিতে সরকারি দলের একাধিক প্রার্থী থাকার সুবিধা পেয়েছেন বিএনপি ও অন্য দলের প্রার্থীরা। বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নিলেও দলটির সাতজন স্বতন্ত্রভাবে লড়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন।
একইভাবে জামায়াতের একজন চেয়ারম্যান হয়েছেন। দলীয় প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে একটি ইউপিতে চেয়ারম্যান হয়েছেন বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির প্রার্থী। এর বাইরে চারটিতে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জিতেছেন।
এমন পরিস্থিতির জন্য দলীয় সঠিক প্রার্থীকে মনোনয়ন না দেওয়া এবং অভ্যন্তরীণ কোন্দলকে দায়ী করেছেন আওয়ামী লীগের মাঠপর্যায়ের কয়েক নেতা। ইউপি নির্বাচনের ফল বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
এর আগে ২১ জুন অনুষ্ঠিত ১৬৯টি ইউপি নির্বাচনে একই ধরনের ফল পাওয়া গেছে। ওই নির্বাচনে ভোটের লড়াইয়ে ৪৯ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়ী হয়েছিলেন। তাদের প্রায় সবাই আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী ছিলেন।
ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ১২০ জন, জাতীয় পার্টির তিনজন, জাতীয় পার্টি-জেপির তিনজন ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের একজন প্রার্থী জয়লাভ করেন।
আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের পরাজয়ের বিষয়ে মূল্যায়ন জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বলেন, যেসব ইউনিয়ন পরিষদে বিদ্রোহী প্রার্থীরা দাঁড়িয়েছেন, সেখানে ভোট বিভক্ত হয়ে গেছে।
ওই সুযোগ নেয় স্বাধীনতাবিরোধী বিএনপি-জামায়াত। তারা আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে হারিয়ে দিতে বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে অবস্থান নেয়। এতে বিদ্রোহী প্রার্থীরা আওয়ামী লীগের একাংশের ভোট পান, আবার বিএনপি-জামায়াতেরও ভোটও পায়। ফলে তারা জয়ী হন। বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলে এমন ফল হতো না।
সোমবার দেশের ৬ জেলার ১৬০টি ইউনিয়ন পরিষদে ভোট হয়। ৪৩টি ইউনিয়নে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা জয় পাওয়ায় সেগুলোয় চেয়ারম্যান বাদে বাকি পদে ভোট হয়। বাকি ১১৭টিতে চেয়ারম্যান পদে ভোট হয়েছে।
এ নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ৪৩ জনসহ আওয়ামী লীগের মোট ১১৯ জন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। এ নির্বাচনে ইভিএম’এ (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) ভোট হওয়া আট ইউপিতে ৬৯ দশমিক ৭৮ শতাংশ ভোট পড়েছে। আর ব্যালটে ভোট হওয়া ১০৯টিতে ভোট পড়েছে ৬৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ।
ফলাফল বিশ্লেষণে আরও দেখা যায়, সাতক্ষীরা জেলার দুটি উপজেলার ২১টির মধ্যে ৯টিতে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী জয়ী হয়েছেন। অপরদিকে দলটির বিদ্রোহী প্রার্থী জিতেছেন সাতটি ইউপিতে।
সেগুলো হচ্ছে-কয়লা, জয়নগর, জালালাবাদ, কেড়াগাছি, চন্দনপুর, খেসড়া ও সরুলিয়া। এ জেলার তিন ইউপি কলোরোয়ার হেলাতলা, তালার ধানদিয়া ও জালালপুরে বিএনপি এবং ইসলামকাটিতে জামায়াত নেতা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন।
খলিষখালী ইউনিয়নে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির প্রার্থী মোল্লা সাব্বির হোসেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী মো. মোজাফফর রহমানকে হারিয়ে জয়ী হয়েছেন।
বেশির ভাগ ইউপিতে পরাজয়ের বিষয়ে সাতক্ষীরা জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান বাবু বলেন, এবারের নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের যেসব প্রার্থী হেরে গেছেন, তাদের জনপ্রিয়তায় ঘাটতি ছিল।
তিনি বলেন, পরাজিতরা আগের নির্বাচনেও অংশগ্রহণ করে জয়লাভ করেছিলেন। এবার জনসম্পৃক্ততা কম থাকায় তারা জয় পাননি। অপরদিকে দলের স্থানীয় পর্যায়ের বেশকিছু গ্রুপিং-কোন্দল আছে।
একে অন্যকে ঘায়েল করার চেষ্টা করেছেন। এই সুযোগে বিএনপি-জামায়াতদলীয় কয়েকজন প্রার্থী চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন।
খুলনার দিঘলিয়া উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়ন পরিষদের ভোট হয়েছে। একটিতেও সরকারি দলের প্রার্থীরা জয় পাননি। গাজীরগাট ইউপির একটি কেন্দ্রের ভোট স্থগিত থাকায় পুরো ফল ঘোষণা করা হয়নি।
এ ইউপিতে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী মো. মফিজুল ইসলাম এগিয়ে আছেন। ফলাফল ঘোষিত চারটি ইউপির তিনটিতে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী এবং একটিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়ী হয়েছেন।
খুলনা জেলার ৩৪টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের আটজন ও স্বতন্ত্র তিনজন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। দুটি ইউপিতে ফল স্থগিত রয়েছে। বাকি ২১টিতে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী জিতেছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হারুনুর রশীদ বলেন, কয়েকটি ইউপিতে সঠিক ব্যক্তিকে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। যেসব প্রার্থী হেরে গেছেন, তাদের মধ্যে জয়ের ব্যাপারে ওভার কনফিডেন্স (অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস) ছিল।
তারা ভোটারের কাছে খুব বেশি একটা যাননি। অপরদিকে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীরা ভোটারদের দ্বারে দ্বারে গিয়ে মন জয় করেছেন। তবে যাই হোক না কেন, আওয়ামী লীগের বাইরে ভোট যায়নি।
আরও দেখা যায়, বাগেরহাটের দুটি ইউপিতে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন। বাকি ৬৪টিতেই দলীয় প্রার্থী জিতেছেন। নোয়াখালীর ১৩টি ইউপির মধ্যে চারটিতে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী ও চট্টগ্রামের সন্দ্বীপের ১২টির মধ্যে দুটিতে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী জয়ী হয়েছেন।
কক্সবাজারের ১৪টি ইউপির মধ্যে দুটিতে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী ও চারটিতে বিএনপি নেতারা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। বাকি ৬টিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জয়ী হয়েছেন। একটি ইউপির ভোট স্থগিত রয়েছে।
সুএ,যুগান্তর